সুলতানী আমলে বাংলার ইতিহাসকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজীর বঙ্গ বিজয় থেকে শুরু করে বাংলায় দিল্লীর সুলতানী শাসনের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। বাংলার আমীর শাসকরা ও দিল্লীর বিরুদ্ধে নিজেদের মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু ইলিয়াসশাহী বংশের প্রতিষ্ঠার পূর্বে বাংলা মূলত দিল্লীর কর্তৃত্বাধীন ছিল। এরপর মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে ১৩৪২ খ্রীষ্টাব্দে ইলিয়াসশাহ লক্ষৌতি বা গৌড়-এ শাসন ক্ষমতা দখল করেন এবং বাংলায় স্বাধীন মুসলিম শাসনের প্রবর্তন হয়। ইলিয়াসশাহী বংশের পর হুসেনশাহী বংশের (১৪৯৩ খ্রীঃ–১৫৩৫ খ্রীঃ) শাসনকালে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক নবযুগের সূচনা হয় এবং বাংলা তার নিজস্ব আঞ্চলিক মণীষার মাধ্যমে স্বতন্ত্রভাবে বিকাশের পথে অগ্রসর হয়।
সুলতানী আমলে বাংলার সমাজ জীবন
সুলতানী আমলে বাংলায় রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টি হয়। ইলিয়াসশাহ তাঁর রাজ্যকে “বাংলা” আখ্যা দেন অর্থাৎ সমগ্র বাংলার জাতীয় শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। বস্তুতপক্ষে বহিরাগত মুসলিম শাসকগণ বাংলার জনগণের সঙ্গে নৈকট্য স্থাপন করেন। হিন্দুদের বহু উচ্চ পদে নিযুক্ত করেন।
ইলিয়াসশাহী ও হুসেনশাহী এই দুই রাজবংশের দুই শত বর্ষব্যাপী রাজত্বকালে বাংলার সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে নানা সংস্কার সাধিত হয়। বাংলায় মুসলিমদের আগমন থেকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের সময় পর্যন্ত বাংলার সমাজ জীবনে দুই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। একদিকে হিন্দু সমাজ সংস্কারকদের লক্ষ্য ছিল সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত করা, বর্ণভেদ প্রথা নিয়ন্ত্রিত করা এবং সামাজিক আচার অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট করা। হিন্দু সমাজ চারটি বর্ণে বিভক্ত হয়ে পড়ে—যেমন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য ও বৈশ্য। হিন্দু সমাজে বর্ণভেদ প্রথা কঠোর ভাবে বলবৎ করা হয়। অন্যদিকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য ও তাঁর অনুগামীদের ভক্তিবাদী ধর্ম আন্দোলনের প্রসারের ফলে বাংলার সমাজ জীবনে বর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা কিছুটা শিথিল হয়ে যায়। বৈষ্ণব ধর্মে বর্ণভেদ ও জাতিভেদ প্রথার তেমন স্থান ছিল না। স্বাভাবিক ভাবে সাধারণ জনজীবনে বৈষ্ণবধর্ম জনপ্রিয়তা লাভ করে। বৌদ্ধদের মধ্যে অনেকে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হন।
আলোচ্য সময়ে বাংলায় মুসলিম সমাজেও কিছু পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। মুসলিম গাজী, আউলিয়া সাধু-সন্তগণ এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন। অনেক হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় বাংলায় এক নতুন মুসলিম সমাজের উন্মেষ ঘটে। হিন্দুদের অনেক আচার অনুষ্ঠান মুসলিম সমাজকে স্পর্শ করে। সাধারণভাবে ইসলাম ধর্মে বর্ণ বা জাতিভেদের কোন স্থান নেই। কিন্তু বাংলায় মুসলিম সমাজে প্রধানত দুটি সুস্পষ্ট স্তর দেখা যায়—উচ্চও নীচ। উচ্চ শ্রেণীর মুসলিমরা ছিলেন গোঁড়া ও রক্ষণশীল; অন্যদিকে নীচু শ্রেণীর মধ্যে বৃত্তি অনুসারে তারতম্য সৃষ্টি হয়।
সুলতানী আমলে বাংলার নগর বিন্যাস :
সুলতানী আমলে আন্তর্জাতিক বাণিজাল, ধন-সম্পদ বাংলায় উন্নতমানের নগর সভ্যতার বিকাশে সহায়ক হয়। গৌড়, পাণ্ডুয়া, সোনারগাঁও, চাটগাঁও ও সাতগাঁও-এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সমকালীন বৈদেশিক পর্যটকদের নজর কেড়েছিল। সব বিদেশী পর্যটক ও বণিক চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে সোনারগাঁও হয়ে পাণ্ডুয়া
যেতেন। পাণ্ডুয়া ও গৌড় এই দুটি নগরের রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। গৌড় ছিল শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল।
সুলতানী আমলে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবন :
বাংলার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইলিয়াসশাহী ও হুসেনশাহী বংশের অবদান নেহাৎ তুচ্ছ নয়। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ইলিয়াসশাহী ও হুসেনশাহী শাসকেরা সাহিত্য ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করে বাংলার মনীষার উন্মেষে খুবই সহায়ক হয়েছিলেন। এই যুগের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল বাংলা ভাষায় সংস্কৃত মহাকাব্য ও কিছু কিছু পৌরাণিক উপাখ্যানের অনুবাদ। এই প্রসঙ্গে কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ, ‘মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ইত্যাদির উল্লেখ করা যায়। চণ্ডীদাস হলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ ও অবিস্মরণীয় কবি। তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে ইলিয়াসশাহী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা সর্বজনবিদিত। সুলতান বারবক শাহ্ মালাধর বসু ও তাঁর পুত্রকে যথাক্রমে ‘গুণরাজ খাঁ’ ও সত্যরাজ খাঁ অভিধায় সম্মানিত করেছিলেন। শফর-নামা’কাব্যের রচয়িতা মুসলিম পণ্ডিত ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকী বারবক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। সম্ভবত তিনি ছিলেন বারবক শাহের সভাকবি। ইলিয়াসশাহী সুলতান জালাল উদ্দিন-ফতে শাহের আমলে বিজয়গুপ্ত সর্বপ্রথম ‘মনসামঙ্গল ‘কাব্য রচনা করেন।
ইলিয়াসশাহী শাসকদের অনেকেই ছিলেন শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক। এই আমলে শিল্পকলার অগ্রগতি দেখা যায়। এই আমলের অনেক শিলালিপি, মাদ্রাসা, খানকাহ্, স্মৃতিস্তম্ভ—প্রভৃতি দৃষ্টান্ত থেকে শিল্পকলার প্রতি ইলিয়াসশাহী শাসকদের উৎসাহের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইলিয়াস শাহ্ ছিলেন হাজীপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। সিকন্দর শাহ্ পাণ্ডুয়া নগরীকে নানা হর্ম্য, মসজিদ ও তোরণ দিয়ে সুসজ্জিত করেছিলেন। স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে তাঁর নির্মিত আদিনা মসজিদ সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। সিকন্দর শাহের আমলে নির্মিত ‘আখি-সিরাজউদ্দিন’, ‘সমাধিস্থল’ ও ‘কোতওয়ালি দরওয়াজা’র মসজিদের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইলিয়াসশাহী আমলের বাংলার সাংস্কৃতিক ধারা হসেনশাহী আমলেও অব্যাহত থাকে। হুসেনশাহী আমলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্থানীয় মনীষার ভিত্তির ওপর বাংলার সাহিত্যের নবজাগরণ। এই জাগরণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। এর মূলে ছিল মহাকাব্য ও পৌরাণিক উপাখ্যানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি হুসেনশাহী শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা, ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুত্থান ও চৈতন্যদেবের আবির্ভাব। এই আমলে বাংলায় ভাবপ্রবণ ও মানবতাবাদী কাব্যের উৎকর্ষ ঘটে। আলাউল ও দৌলত কাজীর কাব্যের ভাবপ্রবণতার প্রকাশ দেখা যায়। নবদ্বীপে নব্য-ন্যায়সংঘের প্রতিষ্ঠা বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চৈতন্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক বিরাট জাগরণের পথ রচনা করে যান। চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় পরমেশ্বর সর্বপ্রথম ‘মহাভারত’বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। হুসেনশাহী আমলে যশোরাজ খাঁ, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী প্রমুখ পণ্ডিতরা রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। অন্যদিকে, রাজদরবারের সাহায্য ছাড়াই বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস প্রমুখ ‘মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ইসেনশাহী আমলে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে ধর্মেরও এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, শৈবধর্ম, সুফীধর্ম ছাড়াও এই আমলে বহু আঞ্চলিক ধর্মমত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা দেখা যায়, যথা—নাথ, ধর্মঠাকুর প্রভৃতি। হিন্দুদের মত মুসলমানদের মধ্যেও তান্ত্রিক
ক্রিয়াকলাপ যথেষ্ট প্রচলিত দেখা যায়। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের ফলে ষোড়শ শতকে বাংলায় এক অভিনব বৈষ্ণব সম্প্রদায় ও ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা হয়। বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনেও এর প্রভাব পড়ে।
হসেনশাহী আমলে শিল্পকলাও উন্নত অবস্থায় দেখা যায়। এই আমলের স্থাপত্য-শিল্পের অন্যতম নিদর্শন হল ‘দাখিল দরওয়াজা’, ‘একলাখি ‘সমাধি মন্দির, ‘তাঁতিপাড়া মসজিদ ইত্যাদি। এই আমলে ইঁট ও পাথর দিয়ে তৈরী গৌড়ের ‘বড় সোনা’ও ‘ছোট সোনা মসজিদ দুটি স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এই আমলে ‘হস্তলিখন’ শিল্প (calligraphy) খুবই উৎকর্ষ লাভ করে। সোনা ও রুপোর মুদ্রা থেকে বিভিন্ন ধরনের হস্তলিখন-প্রণালীর পরিচয় পাওয়া যায়।
Leave a comment